News Catagory

Monday 7 July 2014

অস্কারই আজ ব্রাজিলের ‘নেইমার’?

নেইমার নেই। আজ তাঁর জায়গা নেবেন কে? জার্মানির সঙ্গে সেমিফাইনাল-যুদ্ধে নামার আগে ব্রাজিলিয়ানদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এটাই। শুধু ব্রাজিলিয়ানদের স্বপ্নসারথিই নন, পারফরম্যান্স দিয়ে নেইমার হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বকাপেরই মুখ। তাঁর শূন্যতা ব্রাজিলের অন্য কারও পক্ষেই পূরণ করা সম্ভব নয়। তা না হলেও তাঁর জায়গা তো একজনকে নিতেই হবে। সেই একজনটা কে?

রেকর্ডের বরপুত্র

বিশ্বসেরা ফুটবলারের মুকুটটা নিয়ে তাঁদের লড়াই৷ ব্রাজিল বিশ্বকাপে যেটির ঝাঁজ আরও বাড়বে৷ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসির রোমাঞ্চকর উত্থান ও সাফল্যের গল্প নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন ১১
বল দখলের লড়াইয়ে রোনালদো ও মেসি৷ ২০১১ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সে​েলানার খেলার একটি মুহূর্তঅবিশ্বাস্য, কিন্তু বাস্তব৷ এক পঞ্জিকা বর্ষে ৯১ গোল! গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড৷ যেন গোলের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন ফুটবল জাদুকর৷
এমন গোলমেশিনকে কে না ভয় পায়! কোনো কারণে মেসি খেলতে না পারলে প্রতিপক্ষ শিবিরে বয়ে যায় আনন্দের ফোয়ারা৷ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন ডিফেন্ডাররা, ‘গোলমেশিনকে তো আর সামলাতে হবে না!’ বায়ার্ন মিউনিখের মিডফিল্ডার জাভি মার্টিনেজ তো একবার বলেই ফেলেছিলেন, ‘ও খেলবে না, এটাই বিরাট স্বস্তির৷’
২০০৪ সালে বার্সেলোনার মূল দলে অন্তর্ভুক্তি৷ সেই থেকে প্রতিপক্ষ শিবিরে আতঙ্ক ছড়িয়েই চলেছেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি৷ ভেঙে চলেছেন একের পর এক রেকর্ড৷ সৃষ্টি করছেন নতুন নতুন ইতিহাস৷
এই ধরণিতে এমন খেলোয়াড়ও আছেন, যিনি একবার ফিফা ব্যালন ডি’অরের জন্য মনোনীত হতে পারলেও নিজেকে ধন্য মনে করেন৷ কিন্তু এই দুর্লভ পুরস্কারটিই মেসির হাতে উঠেছে টানা চারবার৷ ২০০৯ সালে শুরু হয়ে ২০১২ সাল পর্যন্ত ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদার পুরস্কারটি নিজের করে নিয়েছিলেন মেসি৷ সেখানেই শেষ নয়; প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে তিনবার ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু পুরস্কারও পেয়েছেন৷
মাত্র ২৪ বছর বয়সে বার্সেলোনার পক্ষে সর্বোচ্চসংখ্যক গোল, লা লিগার ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে (২৫ বছর) ২০০ গোলেরও মালিক এই আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড৷
ক্লাবের হয়ে রেকর্ডের পর রেকর্ড৷ একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি টানা চার মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা৷ ইউরোপের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চসংখ্যক চারটি হ্যাটট্রিকেরও মালিক৷ এর মধ্যে একটি ম্যাচে তো ইতিহাসই গড়েছেন৷ ২০১২ সালে বেয়ার লেভারকুসেনের বিপক্ষে ম্যাচে পাঁচটি গোলই করেন এই বিস্ময়৷ একটানা কতটি ম্যাচে গোল করা যায়? কল্পনা করুন তো! পাঁচটি, দশটি, পনেরিট, বিশটি! মেসি আপনার কল্পনাশক্তিকেও ছাড়িয়ে গেছেন৷ লা লিগার মতো শীর্ষপর্যায়ের একটি লিগে টানা ২১ ম্যাচে গোল করার কৃতিত্ব তাঁর৷ এর মধ্য দিয়ে পেশাদার লিগে সব কটি দলের বিপক্ষে টানা গোল করার রেকর্ডও এখন তাঁর৷ চোটের কারণে পরের ম্যাচে নামতে পারেননি৷ নইলে কে জানে, এই গোলমেশিন কোথায় থামত!
বয়স এখনো মধ্য গগনে৷ সামনে অফুরান সময়৷ কিন্তু এরই মধ্যে ক্লাবের হয়ে সম্ভাব্য সব অর্জন হয়ে গেছে৷ ছয়টি লা লিগা, দুটি কোপা দেল রে, ছয়টি স্প্যানিশ সুপার কাপ, তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, দুটি উয়েফা সুপার কাপ ও দুবার জিতেছেন ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ৷
ক্লাবের হয়ে রাশি রাশি সাফল্য৷ কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে মেসি কী করেছেন, দেখা যাক সেই খতিয়ান৷ খুব বেশি সমৃদ্ধ না হলেও আর্জেন্টিনার মানুষের মনে সাম্প্রতিক সময়ে খুশির খোরাক জুগিয়েছেন তিনিই৷ ২০০৫ সালে তাঁর হাত ধরেই অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ ঘরে তোলে নীল-সাদারা৷ টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার পাশাপাশি সর্বোচ্চ গোলদাতাও হন তিনি (৬)৷ বিশ্বকাপ অভিষেক ২০০৬ সালে৷ আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে তিনিই সবচেয়ে ছোট খেলোয়াড়৷
২০০৭ সালে কোপা আমেরিকায় দাপটের সঙ্গে ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা৷ কিন্তু শেষ ম্যাচে ব্রাজিলের দুরন্ত ফুটবলের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ৷ মাচেরানোদের ব্যর্থতার পাল্লা হলো আরও ভারী৷ কিন্তু টুর্নামেন্টের সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরস্কার ঠিকই উঠেছে মেসির হাতে৷ জাতীয় দলের হয়ে তাঁর প্রথম সাফল্য আসে ২০০৮ সালে, বেইজিং অলিম্পিকে৷ আর্জেন্টিনা অলিম্পিক ফুটবল দল সোনা জিতে তবেই দেশে ফেরে৷
ছোট্ট জীবনে এ পর্যন্ত অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার৷ ওয়ার্ল্ড সকার প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার তিনবার, উয়েফা সেরা খেলোয়াড় একবার, উয়েফা ক্লাব ফুটবলার অব দ্য ইয়ার একবার, ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ গোল্ডন বল দুবার, এলএফপি সেরা খেলোয়াড় পাঁচবার, লা লিগা সেরা খেলোয়াড় তিনবার, লা লিগা সেরা বিদেশি খেলোয়াড় তিনবার ও পিচিচি ট্রফি তিনবার জিতেছেন এই স্ট্রাইকার৷
কাতালুনিয়ায় মেসি সোনার ডিম পাড়া হাঁস৷ সেখানে তাঁকে ছাড়া চিন্তাই করা যায় না৷ সম্প্রতি তিনি ছন্দে নেই৷ বার্সার ট্রফি কেসেও যেন বদল আসে না৷ বায়ার্ন মিউনিখের সাবেক কোচ হেইঙ্কেস একবার সত্যিই বলেছিলেন, ‘মেসি ছাড়া গল্পটা ভিন্ন৷ ও-ই বার্সার ভিত্তি৷’
সূত্র: বিভিন্ন সময়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন, একাধিক ওয়েবসাইট ও লুকা কাইয়োলির বই মেসি৷

‘আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে চাই’

২৬ বছর তেমন কিছুই নয়৷ এই ছোট্ট কাঁধ এরই মধ্যে হয়ে উঠেছে অনেক চওড়া, ছাড়িয়ে গেছেন অনেক তারকাকে৷ সামনে অমরত্ব লাভের হাতছানি৷ তার পরও লিওনেল মেসিকে পুরোপুরি মূল্যায়নের সময় হয়তো এখনো হয়নি৷ এই বিশ্বকাপই অনেকটা বলে দেবে, ইতিহাসে কোথায় জায়গা পাবেন আর্জেন্টাইন জাদুকর৷ মেসি কিন্তু তাঁর লক্ষ্যে অবিচল৷ উপভোগ করতে চান প্রতিটা মুহূর্ত৷ ঢেলে দিতে চান সামর্থ্যের সবটুকু৷
ইতালিয়ান ক্রীড়ালেখক লুকা কাইয়োলিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সময়ের এই সেরা খেলোয়াড়৷ সেখানেই উঠে এসেছে তাঁর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পেশাদার জীবনের নানা কিছু৷
কাইয়োলি: জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত েকানটি?
মেসি: আর্জেন্টিনা থেকে স্পেনে পাড়ি দেওয়া৷ আমি আমার বাড়ি, বন্ধুবান্ধব ও দেশের মানুষকে ছেড়ে চলে আসি৷ স্পেনে প্রথম কয়েক বছর খুবই কষ্টে কেটেছে৷ এমনও সময় গেছে, আমি ও আমার বাবাই শুধু স্পেনে৷ বাকিরা রোজারিওতে৷ আমার মা, দুই ভাই ও ছোট বোনকে খুব মিস করেছি৷ ঘরে বসে একা কেঁদেছি৷
কাইয়োলি: আর সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত?
মেসি: আমার ছেলে থিয়াগোর জন্ম৷
কাইয়োলি: পেশাদারি জীবনের আনন্দময় মুহূর্ত কোনটি?
মেসি: বার্সেলোনা ও আর্জেন্টিনার হয়ে শিরোপা জয়৷
কাইয়োলি: ব্যালন ডি’অর ট্রফি জয়টা কীভাবে দেখছেন?
মেসি: একটা ব্যালন ডি’অর জয়ই যেখানে অবিশ্বাস্য কিছু, সেখানে চারটি ব্যালন ডি’অর! এটা অসাধারণ৷
কাইয়োলি: আপনি তো এখন বিশ্ব ফুটবলের রাজা...
মেসি: আমি আগের মতোই আছি৷ বড় একটি দলের অংশ হতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি৷
কাইয়োলি: এবার অতীতে ফেরা যাক৷ আপনার ফুটবলজীবনের প্রথম স্মরণীয় মুহূর্ত কোনটি?
মেসি: গ্রানদোলিতে একেবারে গোড়ার দিকের কথা৷ আফি লিগের অ্যামানিসের বিরুদ্ধে খেলা৷ সবাই বলাবলি করছিল, তারাই (অ্যামানিসের) সেরা, তারাই হবে চ্যাম্পিয়ন৷ আমার গোটা পরিবার মাঠে বসে খেলা দেখছিল৷ আমি চার গোল করলাম৷ এর একটি ছিল আবার অসাধারণ৷
কাইয়োলি: ফুটবলের প্রতি কেন এত ভালোবাসা?
মেসি: আমি নিজেও জানি না৷ অন্য সবার মতো শৈশবে আমারও এটির প্রতি প্রথম ভালোবাসা জন্মে৷ আমি এখনো এটি উপভোগ করি৷ ফুটবল খেলাটা আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিসের একটি৷
কাইয়োলি: কোথা থেকে এত সব কৌশল শিখলেন?
মেসি: প্রতিটা মুহূর্ত বলের সঙ্গে কাটিয়ে৷ আমি যখন ছোট ছিলাম, সারাক্ষণ বল নিয়ে কারিকুরি করতাম৷
কাইয়োলি: ফুটবলের প্রতি আপনার ভালোবাসার উৎস কে?
মেসি: আমার নানি সেলিয়া৷ তিনিই আমাকে প্রথম মাঠে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ তিনি ছিলেন আমাদের সবার কাছে

লিও না ডিয়েগো, কারটি সেরা?

‘আবারও বার্সার দখলে মাঠ
জাভি...
মেসির হঠাৎ দিক পরিবর্তন
তিনি বল নিয়ে ছুটছেন, নাচোকে পেছনে ফেললেন
বক্সের ভেতর...আবারও দিক পরিবর্তন
বলটি মনে হয় তেড়েফুঁড়ে যাচ্ছে...
মেসির গোওওওওওল
অবিশ্বাস্য...
চারজনকে কাটিয়ে গোল। হতবিহ্বল গোলরক্ষক
কোনো সন্দেহ নেই, মৌসুমের সেরা গোল
বিস্ময়কর। গোটা বিশ্ব হতবাক। গতি, সামর্থ্য, ধোঁকা, ফিনিশিং—কী অসাধারণ প্রদর্শনী। সত্যিই মন ভরে গেল
কোনো তুলনা নেই । কিন্তু ম্যারাডোনার কথা মনে করিয়ে দিল গোলটি। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের ছয়জন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে এমনই একটি গোল করেছিলেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি। দুটিই ভিন্ন গোল। খেলোয়াড়ও আলাদা। আমি বলছি না, এ গোলের মাধ্যমে মেসি ম্যারাডোনা হয়ে গেছে। কিন্তু এটি আমাকে সেই গোলের কথাই মনে করিয়ে দিল।’
ডিজিটাল প্লাস টেলিভিশনের ধারাভাষ্যকারের বর্ণনা এটি। বার্সেলোনা-গেটাফের ম্যাচে মেসির সেই অবিশ্বাস্য গোলটির বর্ণনা দিতে গিয়ে যেন ভাষাই হারিয়ে ফেলেছিলেন চ্যানেলটির ভাষ্যকার।
গুরুত্বের বিবেচনায় গোল দুটি পুরোই আলাদা। একটি কোপা দেল রের সেমিফাইনাল। অন্যটি বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল। আবার ম্যারাডোনাটির মাহাত্ম্য বেশি অন্য কারণেও। ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড দ্বীপ নিয়ে আর্জেন্টিনা ও ইংল্যান্ডের মধ্যে যুদ্ধের পর সেবারই প্রথম দেশ দুটি ফুটবলে মুখোমুখি হলো।
আবার নায়ক দুজনও আলাদা। ম্যারাডোনা ‘ফুটবল-ঈশ্বর’, বয়স ২৫ বছর৷ মহাতারকা৷ আর মেসি? তখনো ‘মেসি’ হয়ে ওঠেননি। মাত্রই ১৯ বছরের এক তরুণ। দুই বছরও হয়নি, লা লিগা ও জাতীয় দলে অভিষেক ঘটেছে।
কিন্তু গোল দুটির ধরন প্রায় অভিন্ন। মনে হয়, একজন আরেকজনের কাছ থেকে শিখেছেন৷ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লক্ষ্য ভেদ করেছেন গোলবারে৷
২০০৭ সালের ১৮ এপ্রিল মেসির ওই গোলটির পর সারা বিশ্বেই হইচই। ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ল গোলটি। অনলাইনে

বদলে যাওয়া সময়, বদলে যাওয়া দুই দল

ব্রাজিল বনাম জার্মানি।
তার মানে তো শিল্প বনাম যন্ত্র।
সৃজনশীলতার আনন্দ বনাম যান্ত্রিকতার একঘেয়েমি।
একটা সময় এমনই ছিল। যখন খুব সহজেই এই দুটি দলকে বিশেষায়িত করে ফেলা যেত। যখন এই দুটি দল ছিল পুরো বিপরীত মেরুর দুই দর্শনের প্রতীক। ফুটবলের দুই ভিন্ন ঘরানার সবচেয়ে উজ্জ্বল দুই প্রতিনিধি।
আজ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে যখন সেই ব্রাজিল আর জার্মানি মুখোমুখি, প্রায় শতাব্দী প্রাচীন ওই ধারণা কী হোঁচটটাই না খাচ্ছে! ব্রাজিল মানেই এখন আর আনন্দদায়ী ফুটবলের ফল্গুধারা নয়; বরং ব্রাজিলের খেলা দেখে ‘জোগো বনিতো’ অনুরক্তদের মনে প্রায়ই গুনগুন করে ওঠেন শচীন কত্তা, ‘তুমি আর নেই সেই তুমি।’ পরের লাইনটা ‘জানি না জানি না কেন এমন হয়’ হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণটা যে জানা! সাফল্যপিয়াসী সময়।
‘জোগো বনিতো’ কথাটা পেলের উদ্ভাবন। ফুটবল যাঁর কাছে ছিল ‘ও জোগো বনিতো’-দ্য বিউটিফুল গেম। সেই পেলে ১৯৯০ বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানিকে দেখে বলেছিলেন ‘ম্যাথাউস ও দশ রোবট।’
জার্মানি তখন তা-ই ছিল। কালেভদ্রে দেখা মিলত বেকেনবাওয়ার-ম্যাথাউসের মতো সৃষ্টিশীল কোনো খেলোয়াড়ের। বাকি সবাই যেন প্রোগ্রাম করা রোবট। কিন্তু সময় কত কিছুই না বদলে দেয়! ব্রাজিল যেমন বদলে গেছে, বদলে গেছে সেই জার্মানিও। জার্মানির খেলা এখন শুধু শক্তি আর গতির প্রদর্শনী নয়। এই বিশ্বকাপে অন্য যেকোনো দলের চেয়ে পাঁচ শর বেশি সফল পাস খেলেছে জার্মানি। বদলে যাওয়া দুই দলকে বোঝাতে যে পরিসংখ্যানটা জরুরি, তা হলো ব্রাজিলের চেয়ে সংখ্যাটা হাজার খানেক বেশি!
গত পরশু জার্মানির বেস ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলনে বাস্তিয়ান শোয়েনস্টাইগারও বদলে যাওয়া সময়ের কথাই বললেন, ‘ব্রাজিলিয়ানদের কথা ভাবলেই আপনার মনে হবে বল পায়ে জাদুকর। কিন্তু ওই দল বদলে গেছে, ওরা এখন আর আগের মতো খেলে না। শারীরিক শক্তি এখন তাদের খেলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের এ জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, রেফারিকেও।’ জার্মান কোনো খেলোয়াড় ব্রাজিলের মুখোমুখি হওয়ার আগে প্রতিপক্ষের শারীরিক শক্তিনিভর্র খেলার কথা ভেবে রেফারিকে সচেতন করে দিচ্ছেন, ফুটবলে কোনো দিন এমন কিছু ঘটবে বলে কি ভেবেছিলেন কেউ!
শোয়েনস্টাইগার কথাটা অকারণে বলেননি। কলম্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে নেইমারের ওপর অমন আক্রমণে আড়াল হয়ে গেছে, নইলে মারধরে ব্রাজিলও তো কম যায়নি। ফাউল করেছে ৩১টি, এই বিশ্বকাপে এক ম্যাচে যা সর্বোচ্চ। নেইমারের প্রতি কলম্বিয়ানদের যে ‘মনোযোগ’ ছিল, হামেস রদ্রিগেজের প্রতিও ব্রাজিলিয়ানদের তার চেয়ে খুব একটা কম ছিল না।
এবারের আগে বিশ্বকাপে একবারই মুখোমুখি হয়েছিল এই দুই দল। ২০০২ বিশ্বকাপ ফাইনালের সঙ্গে এবারের দুটি মিল আছে। এবারও ব্রাজিলের কোচের নাম লুইস ফেলিপে স্কলারি এবং জার্মানির পোস্টে তর্কযোগ্যভাবে বিশ্বের সেরা গোলরক্ষক। সেবার ছিলেন অলিভার কান, এবার ম্যানুয়েল নয়্যার।
কিন্তু এক যুগ আগে-পরের ব্রাজিল-জার্মানিতে কত পার্থক্য! ২০০২ ফাইনালে নিরপেক্ষ কোনো দর্শকই জার্মানির জয় চায়নি। কেঁদে-ককিয়ে ফাইনালে ওঠা সেই জার্মানি বেশির ভাগ ম্যাচ জিতেছিল ১-০ গোলে। একঘেয়ে যান্ত্রিকতার সেই দলের বিশ্বকাপ জয় হতো সুন্দর ফুটবলের পরাজয়। ব্রাজিল ছিল অনেক বেশি আকর্ষণীয়। দলে ছিলেন তিন ‘আর’-রোনালদো, রিভালদো ও রোনালদিনহো। যাঁদের পায়ে বল পড়া মানেই ছিল সৃষ্টিশীলতার ফুল ফুটে ওঠা।
শুধু সাফল্যপিয়াসী সময়ই হয়তো একমাত্র কারণ নয়। সুন্দর ফুটবল খেলার জন্য তো সৃজনশীল খেলোয়াড় চাই। নইলে স্কলারি তো তখনো কোচ ছিলেন, এখনো তিনিই কোচ। তিনিই বা কী করবেন, ফ্রেড-হাল্কদের দিয়ে সুন্দর ফুটবল খেলাতে চাইলেই কি পারা যায়!
এই ব্রাজিল দলে যে একজনই ‘জোগো বনিতো’র সত্যিকার প্রতিনিধি ছিলেন, সেই নেইমারও ঝরে গেছেন। ক্যামেরুনের বিপক্ষে ম্যাচে নেইমারকে মনে করে দেখুন। ফুটবলানন্দ কথাটা মনে গুঞ্জরন তুলবেই। কিন্তু সেই নেইমারও বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ার আগে বদলে যাওয়া ব্রাজিলিয়ান ফুটবল দর্শনেরই জয়গান গেয়ে গেছেন। জয়টাই আসল, সেটি এমনকি অর্ধেক গোলে হলেও সমস্যা নেই।
গত এক মাসের অভিজ্ঞতা বলছে, ব্রাজিলের আমজনতা কিন্তু দুটিই চায়। জয় তো চায়ই, সঙ্গে সুন্দর ফুটবলও। যে কারণে ১৯৯৪ সালে দুই যুগের শিরোপাখরা ঘোচানো দলটির চেয়েও সেমিফাইনালেও উঠতে না পারা ১৯৮২-এর সক্রেটিস-জিকো-ফ্যালকাওদের দলটিকে অনেক বেশি হৃদয়ে করে রাখে। অথচ সেই দলের জিকোই স্কলারিকে পরামর্শ দিচ্ছেন জার্মানির বিপক্ষে তিনজন লড়াকু মিডফিল্ডার খেলানোর। ‘লড়াকু’ শব্দটা না জার্মানদেরই বেশি পছন্দ ছিল!
সুন্দর ফুটবল নিয়ে ভাবালুতা জার্মানদের কখনোই ছিল না। জার্মানরা ফলে বিশ্বাসী। বিশ্ব শুধু বিজয়ীদেরই মনে রাখে—এই দর্শনেও। মজাটা হলো, সেই দর্শনের পতাকাবাহী একজনের হাতেই জার্মানির এই পরিবতর্ন। ২০০৬ বিশ্বকাপে ইয়ু‌র্গেন ক্লিন্সমানের জার্মানি শিরোপা জিততে পারেনি, কিন্তু দর্শকদের মন ভরিয়েছে। ক্লিন্সমানের ভাবশিষ্য জোয়াকিম লো সেই ধারাটিকেই এমনভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন যে, ‘জার্মান মেশিনস’ কথাটা এখন আর তেমন শোনাই যায় না। রিওতে এক জার্মান অবশ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বললেন, ‘আগে আমরা ভালো খেলতাম না, কিন্তু জিততাম। এখন ভালো খেলি, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হতে পারি না। কোনটি যে ভালো!’
আজকের ব্রাজিল-জার্মানি ম্যাচটিকে তাই আগের মতো ‘ব্রাজিলিয়ান আর্টিস্টস ভার্সাস জার্মান মেশিনস’ বলা যাচ্ছে না। তবে ব্রাজিলিয়ানরা একটা কথা ভেবে শঙ্কিত হতেই পারে, জার্মানি কিন্তু স্বপ্ন ভাঙার ওস্তাদ। ১৯৫৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানরা ছাড়া বাকি বিশ্ব পুসকাসের ‘ম্যাজিকাল ম্যাগির্য়াসে’র জয় চেয়েছিল, ১৯৭৪ ফাইনালে ক্রুইফের হল্যান্ডের। দুবারই জার্মানি বড় নিষ্ঠুরভাবে সেই স্বপ্নকে ‘হত্যা’ করেছে। ব্রাজিলের বিশ্বকাপ থেকে ব্রাজিলকে বিদায় করে দেওয়াটাও তো একই রকম হবে।