ব্রাজিল বনাম জার্মানি।
তার মানে তো শিল্প বনাম যন্ত্র।
সৃজনশীলতার আনন্দ বনাম যান্ত্রিকতার একঘেয়েমি।
একটা সময় এমনই ছিল। যখন খুব সহজেই এই দুটি দলকে বিশেষায়িত
করে ফেলা যেত। যখন এই দুটি দল ছিল পুরো বিপরীত মেরুর দুই দর্শনের প্রতীক।
ফুটবলের দুই ভিন্ন ঘরানার সবচেয়ে উজ্জ্বল দুই প্রতিনিধি।
আজ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে যখন সেই ব্রাজিল আর জার্মানি
মুখোমুখি, প্রায় শতাব্দী প্রাচীন ওই ধারণা কী হোঁচটটাই না খাচ্ছে!
ব্রাজিল মানেই এখন আর আনন্দদায়ী ফুটবলের ফল্গুধারা নয়; বরং ব্রাজিলের খেলা
দেখে ‘জোগো বনিতো’ অনুরক্তদের মনে প্রায়ই গুনগুন করে ওঠেন শচীন কত্তা,
‘তুমি আর নেই সেই তুমি।’ পরের লাইনটা ‘জানি না জানি না কেন এমন হয়’ হওয়ার
কোনো কারণ নেই। কারণটা যে জানা! সাফল্যপিয়াসী সময়।
‘জোগো বনিতো’ কথাটা পেলের উদ্ভাবন। ফুটবল যাঁর কাছে ছিল
‘ও জোগো বনিতো’-দ্য বিউটিফুল গেম। সেই পেলে ১৯৯০ বিশ্বকাপে পশ্চিম
জার্মানিকে দেখে বলেছিলেন ‘ম্যাথাউস ও দশ রোবট।’
জার্মানি তখন তা-ই ছিল। কালেভদ্রে দেখা মিলত
বেকেনবাওয়ার-ম্যাথাউসের মতো সৃষ্টিশীল কোনো খেলোয়াড়ের। বাকি সবাই যেন
প্রোগ্রাম করা রোবট। কিন্তু সময় কত কিছুই না বদলে দেয়! ব্রাজিল যেমন বদলে
গেছে, বদলে গেছে সেই জার্মানিও। জার্মানির খেলা এখন শুধু শক্তি আর গতির
প্রদর্শনী নয়। এই বিশ্বকাপে অন্য যেকোনো দলের চেয়ে পাঁচ শর বেশি সফল পাস
খেলেছে জার্মানি। বদলে যাওয়া দুই দলকে বোঝাতে যে পরিসংখ্যানটা জরুরি, তা
হলো ব্রাজিলের চেয়ে সংখ্যাটা হাজার খানেক বেশি!
গত পরশু জার্মানির বেস ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলনে বাস্তিয়ান
শোয়েনস্টাইগারও বদলে যাওয়া সময়ের কথাই বললেন, ‘ব্রাজিলিয়ানদের কথা ভাবলেই
আপনার মনে হবে বল পায়ে জাদুকর। কিন্তু ওই দল বদলে গেছে, ওরা এখন আর আগের
মতো খেলে না। শারীরিক শক্তি এখন তাদের খেলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের এ
জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, রেফারিকেও।’ জার্মান কোনো খেলোয়াড় ব্রাজিলের
মুখোমুখি হওয়ার আগে প্রতিপক্ষের শারীরিক শক্তিনিভর্র খেলার কথা ভেবে
রেফারিকে সচেতন করে দিচ্ছেন, ফুটবলে কোনো দিন এমন কিছু ঘটবে বলে কি
ভেবেছিলেন কেউ!
শোয়েনস্টাইগার কথাটা অকারণে বলেননি। কলম্বিয়ার বিপক্ষে
ম্যাচে নেইমারের ওপর অমন আক্রমণে আড়াল হয়ে গেছে, নইলে মারধরে ব্রাজিলও তো
কম যায়নি। ফাউল করেছে ৩১টি, এই বিশ্বকাপে এক ম্যাচে যা সর্বোচ্চ।
নেইমারের প্রতি কলম্বিয়ানদের যে ‘মনোযোগ’ ছিল, হামেস রদ্রিগেজের প্রতিও
ব্রাজিলিয়ানদের তার চেয়ে খুব একটা কম ছিল না।
এবারের আগে বিশ্বকাপে একবারই মুখোমুখি হয়েছিল এই দুই দল।
২০০২ বিশ্বকাপ ফাইনালের সঙ্গে এবারের দুটি মিল আছে। এবারও ব্রাজিলের কোচের
নাম লুইস ফেলিপে স্কলারি এবং জার্মানির পোস্টে তর্কযোগ্যভাবে বিশ্বের
সেরা গোলরক্ষক। সেবার ছিলেন অলিভার কান, এবার ম্যানুয়েল নয়্যার।
কিন্তু এক যুগ আগে-পরের ব্রাজিল-জার্মানিতে কত পার্থক্য!
২০০২ ফাইনালে নিরপেক্ষ কোনো দর্শকই জার্মানির জয় চায়নি। কেঁদে-ককিয়ে
ফাইনালে ওঠা সেই জার্মানি বেশির ভাগ ম্যাচ জিতেছিল ১-০ গোলে। একঘেয়ে
যান্ত্রিকতার সেই দলের বিশ্বকাপ জয় হতো সুন্দর ফুটবলের পরাজয়। ব্রাজিল ছিল
অনেক বেশি আকর্ষণীয়। দলে ছিলেন তিন ‘আর’-রোনালদো, রিভালদো ও
রোনালদিনহো। যাঁদের পায়ে বল পড়া মানেই ছিল সৃষ্টিশীলতার ফুল ফুটে ওঠা।
শুধু সাফল্যপিয়াসী সময়ই হয়তো একমাত্র কারণ নয়। সুন্দর
ফুটবল খেলার জন্য তো সৃজনশীল খেলোয়াড় চাই। নইলে স্কলারি তো তখনো কোচ
ছিলেন, এখনো তিনিই কোচ। তিনিই বা কী করবেন, ফ্রেড-হাল্কদের দিয়ে সুন্দর
ফুটবল খেলাতে চাইলেই কি পারা যায়!
এই ব্রাজিল দলে যে একজনই ‘জোগো বনিতো’র সত্যিকার
প্রতিনিধি ছিলেন, সেই নেইমারও ঝরে গেছেন। ক্যামেরুনের বিপক্ষে ম্যাচে
নেইমারকে মনে করে দেখুন। ফুটবলানন্দ কথাটা মনে গুঞ্জরন তুলবেই। কিন্তু সেই
নেইমারও বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ার আগে বদলে যাওয়া ব্রাজিলিয়ান ফুটবল
দর্শনেরই জয়গান গেয়ে গেছেন। জয়টাই আসল, সেটি এমনকি অর্ধেক গোলে হলেও
সমস্যা নেই।
গত এক মাসের অভিজ্ঞতা বলছে, ব্রাজিলের আমজনতা কিন্তু দুটিই
চায়। জয় তো চায়ই, সঙ্গে সুন্দর ফুটবলও। যে কারণে ১৯৯৪ সালে দুই যুগের
শিরোপাখরা ঘোচানো দলটির চেয়েও সেমিফাইনালেও উঠতে না পারা ১৯৮২-এর
সক্রেটিস-জিকো-ফ্যালকাওদের দলটিকে অনেক বেশি হৃদয়ে করে রাখে। অথচ সেই দলের
জিকোই স্কলারিকে পরামর্শ দিচ্ছেন জার্মানির বিপক্ষে তিনজন লড়াকু
মিডফিল্ডার খেলানোর। ‘লড়াকু’ শব্দটা না জার্মানদেরই বেশি পছন্দ ছিল!
সুন্দর ফুটবল নিয়ে ভাবালুতা জার্মানদের কখনোই ছিল না।
জার্মানরা ফলে বিশ্বাসী। বিশ্ব শুধু বিজয়ীদেরই মনে রাখে—এই দর্শনেও। মজাটা
হলো, সেই দর্শনের পতাকাবাহী একজনের হাতেই জার্মানির এই পরিবতর্ন। ২০০৬
বিশ্বকাপে ইয়ুর্গেন ক্লিন্সমানের জার্মানি শিরোপা জিততে পারেনি, কিন্তু
দর্শকদের মন ভরিয়েছে। ক্লিন্সমানের ভাবশিষ্য জোয়াকিম লো সেই ধারাটিকেই
এমনভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন যে, ‘জার্মান মেশিনস’ কথাটা এখন আর তেমন শোনাই
যায় না। রিওতে এক জার্মান অবশ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বললেন, ‘আগে
আমরা ভালো খেলতাম না, কিন্তু জিততাম। এখন ভালো খেলি, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন
হতে পারি না। কোনটি যে ভালো!’
আজকের ব্রাজিল-জার্মানি ম্যাচটিকে তাই আগের মতো ‘ব্রাজিলিয়ান আর্টিস্টস
ভার্সাস জার্মান মেশিনস’ বলা যাচ্ছে না। তবে ব্রাজিলিয়ানরা একটা কথা ভেবে
শঙ্কিত হতেই পারে, জার্মানি কিন্তু স্বপ্ন ভাঙার ওস্তাদ। ১৯৫৪ বিশ্বকাপ
ফাইনালে জার্মানরা ছাড়া বাকি বিশ্ব পুসকাসের ‘ম্যাজিকাল ম্যাগির্য়াসে’র জয়
চেয়েছিল, ১৯৭৪ ফাইনালে ক্রুইফের হল্যান্ডের। দুবারই জার্মানি বড়
নিষ্ঠুরভাবে সেই স্বপ্নকে ‘হত্যা’ করেছে। ব্রাজিলের বিশ্বকাপ থেকে
ব্রাজিলকে বিদায় করে দেওয়াটাও তো একই রকম হবে।
No comments:
Post a Comment